বিশ্ব মৌমাছি দিবস ২০ এপ্রিল। এবছরের প্রতিপাদ্য : মৌমাছি তারুণ্যের সাথে জড়িত। জানা যায় পৃথিবীতে প্রায় ৩০০০০ প্রজাতির মৌমাছি রয়েছে। একটি মৌমাছি প্রতিদিন ৪০৫০ টি ফুলের কাছে মধু সংগ্রহের জন্য ভ্রমন করে। এর মধ্যে ৮ খেকে ১০ টি হলো সামাজিক মৌমাছি। বাকীগুলো স্বতন্ত্র মৌমাছি। সামাজিক মৌমাছি মধু বা পরাগায়ণে সহায়তা করে। আমাদের কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা,ফসলের পরাগায়ন, মধু উৎপাদনে ও পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার জন্য মৌমাছি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু বর্তমান কালে বন উজার,রাসায়নিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ডের কারণে বাসস্থান হারানো,খাদ্যের অভাব, বায়ুদূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ,অতিরিক্ত গরম, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মৌমাছি বিপন্ন হচ্ছে। সুন্দর বনে ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদ মৌমাছি ব্যবহার করে নেকটার ও পরাগ সংগ্রহের জন্য।
পৃথিবীতে কোনো মৌমাছি না থাকলে মানব সভ্যতা টিকে থাকা অসম্বব হয়ে উঠবে। সমস্যাটি হলো বিশ্বের ১’শ রকমের ফল আর ৯০ ভাগ খাদ্য শস্যের পরাগায়ন হয় মৌমাছির সাহায্যে। মৌমাছি না থাকলে কমে যাবে ফসল কিংবা ফলের উৎপাদন। দেখা দেবে খাদ্য সংকট। তাহলে পৃথিবী কি সে দিকেই এগোচ্ছে ? কারণ গবেষকরা জানাচ্ছেন ১ দশক আগেও বিশ্বজুড়ে যে পরিমাণ মৌমাছি ছিলো, এখন আছে তার মাত্র দুই তৃতীয়াংশ। জাপানে আম উৎপাদনে পরাগায়নের জন্য একধরণে মাছি ব্যবহার করেন। গাছের নীচে পঁচা মাছ রেখে দেয়, মাছি ডিম পাড়ে সেখানে প্রচুর মাছি হয় এবং বয়স্ক মাছিরা পরাগায়ণে সহায়তা করে। আমের ফলন বেড়ে যায়।
বিজ্ঞানরা বলছে পৃথিবী থেকে যদি মৌমাছি হারিয়ে যায়, তাহলে মানব সভ্যতা টিকবে মাত্র ৪ বছর। তার মানে মৌমাছি ছাড়া খুব বেশি টিকে থাকতে পারবেনা মানুষ। কী হবে যদি সত্যি সত্যি মৌমাছি হারিয়ে যায়? মৌমাছি যদি পরাগায়নে সাহায্য না করে তাহলে বাঁচবে না ফসল। মানুষের প্রতি ৩ লোকমা খাবারের মাধ্যে ১ লোকমাই আসে মৌমাছির কারণে। সারা বিশ্বের ৯০ ভাগ আর যুক্তরাষ্ট্রে ৩০ ভাগ খাদ্য দ্রব্যের পেছনে রয়েছে মৌমাছির অবদান।
মানবসৃষ্ট কারনে মৌমাছি কমে যাচ্ছে। আর বিলুপ্তির পথে রয়েছে ইউরোপের ২৪ ভাগ মৌমাছি। বড় বড় কীটনাশক কোম্পানিগুলো, কীটনাশক ও আগাছা নিধনকারী ওষুধ বানাচ্ছে ফসলকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে। যার মধ্যে রয়েছে নিওনিক্স , যা মৌমাছিদের মেরে ফেলে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিওনিক্স সমৃদ্ধ কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। মৌমাছির ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতেও কাজ করছে। কিন্তু ঐ একই উপাদান পাওয়া যাচ্ছে বাগানে ব্যবহৃত কীটনাশকেও।
মৌয়ালিরা সুন্দর বনের মধু করে সেই মধু সংগ্রহ তাদের পেশা টিকে থাকে। ধীরেধীরে সুন্দর বনের মধু কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। মৌমাছি আর ফুলের মধু সংগ্রহ করতে পারছেনা। আমরা যে ফলমূল, শস্যদানা বা শাকসবজি খাই, তার বেশির ভাগই উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন হয় পরাগায়ণ। আর মৌমাছি হলো গুরুত্বপূর্ণ পরাগায়ণকারী প্রকৃতির এক প্রাণ। পৃথিবীর ৭০-১০০ জাতের ফসল উৎপাদনের জন্য আমাদের মৌমাছিকে দরকার। আর এই ফসলগুলো খেয়ে বেঁচে আছে পৃথিবীর ৯০ শতাংশ প্রাণী।
শুধু ফসল উৎপাদন নয়, যে গাছগুলো ফসল উৎপাদনের জন্য ফুল তৈরি করে, তারাও বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে মৌমাছির অভাবে। কারণ, অধিকাংশ গাছ ফুলের পরাগায়ণ ছাড়া বীজ উৎপাদন করতে পারে না। মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে ফুলে পরাগায়ণ ঘটায় মৌমাছি। ফুলের পরাগায়ণ থেকে হয় ফল বা বীজ এবং সেই বীজ থেকে জন্মায় নতুন গাছ। আর আমরা জানি যে খাদ্যশৃঙ্খলের শুরু থেকে শেষ সবই নির্ভর করে উদ্ভিদের ওপর। কাজেই বলা যায় মৌমাছি না থাকলে আমাদের খাদ্য উৎপাদন একেবারে কমে যাবে। পাশাপাশি পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষ আর অন্য প্রাণীদের অস্তিত্ব নিয়েও টানাটানি পড়ে যাবে।
বর্তমান পৃথিবী মৌমাছি সংকটে আছে। আমরা প্রতিবছর লাখ লাখ মৌমাছি হারাচ্ছি। এ জন্য দায়ী শুধুই মানুষ। আমাদের এই সুন্দর গ্রহকে টিকিয়ে রাখার জন্যই মৌমাছিকে প্রয়োজন। মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে মৌমাছিদের আবাসস্থল নষ্ট করে দেয়। আগুন লাগিয়ে মধু সংগ্রহে মৌমাছি মওে গাছের ক্ষতিহয়। মৌচাক এই প্রাণীর বংশবৃদ্ধির একমাত্র স্থান। কিন্তু নিজেদের অজান্তেই সেগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে মানুষেরা। পাশাপাশি আমাদের ফুলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আমাদের যান্ত্রিক পৃথিবীতে এখন ইট-বালু আর কংক্রিটের আধিক্য। ফুলে ভরা মাঠে এখন শোভা পায় আকাশচুম্বী দালান। দালানের ভেতর থাকে কৃত্রিম ফুল আর ঘাস। সেই ফুল নষ্ট হয় না, ঝরে যায় না, গন্ধও ছড়ায় না,মৌমাছিও আসেনা।
এ ছাড়া মৌমাছির সংখ্যা কমার কারণের মধ্যে আছে আমাদের ব্যবহার করা কীটনাশক এবং কাঁকড়া সদৃশ এক ক্ষুদ্র পরজীবী। এই পরজীবী মৌমাছির রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে, তবে ধীরে ধীরে প্রাণ হারায় মৌমাছি। বিজ্ঞানীরা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনকেও মৌমাছির সংখ্যা কমতে থাকার কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন। তারা প্রমাণ করেছেন, পৃথিবীতে মৌমাছির সংখ্যা কমতে থাকা মানুষের জন্য এক অশনি সংকেত।
তাই এই গ্রহের মানুষের জন্য সতর্কবাণী হলো, এবার থেকে মৌমাছিকে বাঁচিরয় রাখার জন্য আমাদের প্রকৃতি দূষণ থেকে ফিরে আসতে হবে। সেই সঙ্গে ফুল আর ফল গাছ দিয়ে ভরিয়ে ফেলতে হবে আমাদেও হাওর,পাহাড়,সমতল,উপকূল,শহরসহ চারপাশ। আমরা সবাই জানি, মৌমাছি মধু উৎপাদন করে। মধু একদিকে যেমন খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তেমনি এর রয়েছে অনেক ওষুধি গুণ। প্রাকৃতিক ও খাঁটি মধু শুধু মৌমাছিই উৎপাদন করতে পারে। মৌমাছিকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছে। আমাদের মৌমাছির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু বড় বড় প্রাণী বাঘ আর হাতি রক্ষার জন্য সংগ্রাম করলেই হবেনা। বাঘ না থাকলে পৃথিবী ও মানুষ বাঁচবে ,কিন্তু মৌমাছি না থাকলে আমরা বিলুপ্ত হতেপারি। ইটালির একটি স্ট্যাম্পে (যা ১৯৫০ সালে প্রকাশিত) একটি চাকের উপর একটি কর্মরত মৌমাছিকে দেখানো হয়েছে। এতে বুঝা যায় সেখানে মৌমাছিকে নিয়ে অনেক আগেই সচেতনতা ও গবেষণা শুরু হয়েছে। আমাদেরকেও ভাবতে হবে প্রকৃতিকে নিয়ে। যদি হঠাৎ করে কোনো কারণে পৃথিবী থেকে মৌমাছি হারিয়ে যায় তাহলে হাজার হাজার উদ্ভিদ এবং লতা-গুল্মও পরিবেশ থেকে হারিয়ে যাবে। আমরা ফিরে পেতে চাই প্রকৃতির মাঝে ফুল, ফল, সবুজ গাছ,লতাপাতা। তরুণপ্রজন্ম এতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।আমরা প্রকৃতি বাঁচাই,মৌমাছি নিজ থেকেই বেঁেচ থাকবে।
অহিদুর রহমান
পরিবেশকর্মী ও আঞ্চলিক সমন্বয়কারী ,বারসিক।